সেমিকন্ডাক্টর কি? সেমিকন্ডাক্টর সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

আজ আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো তা হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর। এটি সম্পর্কে আমরা সবাই কিছু না কিছু জানি। কারণ দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ব্যবহৃত প্রায় সকল ডিভাইসেই সেমিকন্ডাক্টর বিদ্যমান। প্রত্যাহিক জিবনে এর গুরুত্ব কতটুকু তা আমরা নিশ্চয় জানি। তাই আজ আমরা সেমিকন্ডাক্টর সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী কি?
সেমিকন্ডাক্টর এমন একটি পদার্থ যা বৈদ্যুতিক ডিভাইস এবং সরঞ্জামগুলিতে কারেন্টের প্রবাহ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ডিজাইন করা হয়।

সঙ্গাঃ সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী এমন একটি পদার্থ যার পরিবাহীতা (Conductivity) পরিবাহী (Conductor) পদার্থের চেয়ে কম এবং অপরিবাহী (Insulator) পদার্থের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ এর পরিবাহিতা বা কন্ডাক্টিভিটি পরিবাহী এবং অর্ধপরিবাহীর মাঝামাঝি। 
উদাহরনঃ কার্বন, সিলিকন, জার্মেনিয়াম।

সেমিকন্ডাক্টরের রোধের (Resistance) মান সাধারণত ০.৫ থেকে ৫০ ওহমের মাঝামাঝি হয়ে থাকে।

সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসসমূহ :
রেজিস্টর (Resistor)
ক্যাপাসিটর (Capacitor)
ডায়োড (Diode)
Op-Amp = অপারেশনাল এমপ্লিফায়ার (Operational amplifier)
ICs = ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ()
ট্রানজিস্টর (Transistor)
এগুলো ছাড়াও সেমিকন্ডাক্টরের তৈরি অনেক ডিভাইস আমাদের নিয়মিত ব্যবহার করতে হয়।


সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানসমূহ
আসুন দুটি উপাদান সম্পর্কে জেনে নেই যেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।

সিলিকন

সিলিকন এমন একটি উপাদান যা পৃথিবীতে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। এটি পৃথিবীর ভূত্বকে অক্সিজেনের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রাপ্ত মৌল (পৃথিবীর ভরের হিসেবে প্রায় ২৮%)। তবে এটি প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়না। এটি মূলত ধুলি, বালি গ্রহাণুপুঞ্জ এবং গ্রহসমুহে সিলিকনের অক্সাইড (সিলিকা) বা সিলিকেট আকারে থাকে। ইলেকট্রনিক শিল্পে সিলিকনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

জার্মেনিয়াম

জারিনিয়াম এমন একটি রাসায়নিক উপাদান যা সিলিকনের মতো দেখতে একই রকম, এবং এটিও প্রকৃতিতে মুক্ত উপাদান হিসাবে পাওয়া যায় না। পৃথিবীপৃষ্ঠে সহজে পাওয়া যায় এমন মৌলের মধ্যে জার্মেনিয়ামের অবস্থান ৫০তম।


জার্মিনিয়াম তার তাপ সংবেদনশীলতা এবং ব্যয়ের কারণে সিলিকনের চেয়ে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় তবে এটি এখনও কিছু উচ্চ-গতির ডিভাইসে ব্যবহারের জন্য সিলিকনের সাথে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া এবং বেলজিয়াম সহ অন্যান্য বড় উত্পাদকদের পাশাপাশি চীনও জার্মেনিয়াম উত্পাদনে শীর্ষস্থানীয়।

সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহীর বৈশিষ্ট্য
এর সর্ববহিস্থ স্তরে 4 টি ইলেকট্রন থাকে।
এর পরিবাহিতা (Conductivity) পরিবাহির তুলনায় কম এবং অপরিবাহীর (Insulator) তুলনায় বেশি।
এতে বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে এর পরিবাহিতা বাড়ানো বা কমানো যায়।
ডোপিং
বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরের সাথে প্রয়োজনমত ভেজাল পরমাণু বা অপদ্রব্য মেশানোর পদ্ধতিকে ডোপিং বলা হয়।

ডোপিং কেন করা হয়?
বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরে যথেষ্ট পরিমাণে মুক্ত ইলেকট্রন এবং হোল থাকে না। তাই চাহিদা মত কারেন্ট প্রবাহ সৃষ্টি করা যায় না। এজন্য বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরের পরিবাহিতা বৃদ্ধি করার জন্য এর সাথে প্রয়োজনমত ভেজাল বা অপদ্রব্য মেশানো হয় যাতে যখন যেমন কারেন্ট প্রয়োজন তখন তেমন পরিমাণ কারেন্ট প্রবাহ সৃষ্টি করা যায়।

সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহীর প্রকারভেদ :
সেমিকন্ডাকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী দুই প্রকার।

বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর (Intrinsic Semicondctor)
ভেজাল মিশ্রিত বা Extrinsic সেমিকন্ডাক্টর
ভেজাল মিশ্রিত সেমিকন্ডাক্টরকে আবার ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।


p-type সেমিকন্ডাক্টর
n-type সেমিকন্ডাক্টর

বিশুদ্ধ বা ইনট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টর
যেসব সেমিকন্ডাক্টরে কোন ভেজাল উপাদান বা অপদ্রব্য মেশানো থাকেনা তাদেরকে ইনট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টর বলে। যেমন, বিশুদ্ধ সিলিকন,জার্মেনিয়াম।


ইনট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে, স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ইলেকট্রন সংখ্যা = হোল সংখ্যা ।

ভেজাল মিশ্রিত বা এক্সট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টর
বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরের সাথে প্রয়োজনমত ত্রিযোজী বা পঞ্চযোজী পরমাণু অপদ্রব্য বা ভেজাল উপাদান মিশিয়ে যে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করা হয় তাকে ভেজাল মিশ্রিত বা এক্সট্রিনসিক Semi-conductor বলে।

p-type সেমিকন্ডাক্টর
বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরের সাথে প্রয়োজনমত ত্রিযোজী ভেজাল উপাদান মিশিয়ে যে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করা হয় তাকে p-type সেমিকন্ডাক্টর বলে।

বিশুদ্ধ সিলিকন বা জার্মেনিয়াম পরমাণুর সাথে একটি ত্রি-যোজী পরমাণু ভেজাল হিসেবে যুক্ত করলে ত্রি-যোজী পরমাণু্র তিনটি ভ্যালেন্স ইলেকট্রন নিকটবর্তী তিনটি সিলিকনের ভ্যালেন্স ইলেকট্রনের সাথে শেয়ারিং এর মাধ্যমে সমযোজী বা কো-ভ্যালেন্ট বন্ড সৃষ্টি করে।


কিন্তু ত্রিযোজী পরমাণুর যোজ্যতা স্তরে একটি ইলেকট্রনের ঘাটতি থাকায় সিলিকনের চতুর্থ ইলেকট্রনের সাথে বন্ধন তৈরি করতে পারে না। ফলে একটি ফাঁকা স্থান বা হোল সৃষ্টি হয়।

এরকমভাবে প্রত্যেকবার ত্রি-যোজী পরমাণু মেশানোর ফলে একটি করে হোল সৃষ্টি হয়। আর এই হোল পজেটিভ চার্জ বহন করে বলে এই নতুন সেমিকন্ডাক্টরকে বলা হয় p-type সেমিকন্ডাক্টর।

এভাবে যত বেশি অপদ্রব্য বা ভেজাল ডোপিং করা হয় তত বেশি হোল উৎপন্ন হয়। এজন্য পি-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ার হল হোল বা ফাকা স্থান এবং ইলেকট্রন হচ্ছে মাইনোরিটি চার্জ ক্যারিয়ার।

ত্রি-যোজী পরমাণুকে একসেপ্টর বা গ্রহীতা পরমাণুও বলা হয়, কারণ রিকম্বিনেশনের সময় প্রতিটি হোল একটি করে ইলেকট্রন গ্রহণ করে। এরকম আরো গ্রহীতা পরমাণু হল অ্যালুমিনিয়াম, বোরন এবং গ্যালিয়াম।

n-type সেমিকন্ডাক্টর
বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরের সাথে প্রয়োজনমত পঞ্চযোজী অপদ্রব্য বা ভেজাল উপাদান মিশিয়ে যে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করা হয় তাকে n-type সেমিকন্ডাক্টর বলে।


বিশুদ্ধ সিলিকন পরমাণুর সাথে একটি পঞ্চ-যোজী পরমাণু ভেজাল বা অপদ্রব্য হিসেবে মিশানো হলে পঞ্চ-যোজী পরমাণুর চারটি ইলেকট্রন নিকটবর্তী চারটি সিলিকন পরমাণুর ভ্যালেন্স ইলেকট্রনের সাথে শেয়ারিং এর মাধ্যমে সমযোজী বা কো-ভ্যালেন্ট বন্ড সৃষ্টি করার মাধ্যমে তার ভ্যালেন্স ব্যান্ডকে আটটি ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ করে।

ফলে পঞ্চ-যোজী পরমাণুর একটি অতিরিক্ত ইলেকট্রন মুক্ত হয়ে যায়, তখন এই মুক্ত ইলেকট্রনটি কন্ডাকশন ব্যান্ডে চলে যায়। এভাবে যত বেশি অপদ্রব্য বা ভেজাল ডোপিং করা হয় কন্ডাকশন ব্যান্ডের ইলেকট্রন তত বেশি বৃদ্ধি পায়।

এজন্য এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ার হল ইলেকট্রন এবং মাইনোরিটি চার্জ ক্যারিয়ার হল হোল বা ফাকা স্থান। আমরা জানি ইলেকট্রন নেগেটিভ চার্জ বহন করে, এজন্য এভাবে গঠিত ভেজাল সেমিকন্ডাক্টরকে এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর বলা হয়।

পঞ্চ-যোজী পরমাণুকে ডোনর বা দাতা পরমাণুও বলা হয়, কারণ এরা কন্ডাকশন ব্যান্ডে ইলেকট্রন উৎপন্ন করে। দাতা পরমাণু গুলো হল আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি এবং ফসফরাস।

ইনট্রিনসিক এবং এক্সট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টরের মধ্যে পার্থক্য
ইনট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টর এক্সট্রিনসিক সেমিকন্ডাক্টর
এটি প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরে ত্রিযোজী কিংবা পঞ্চযোজী ভেজাল মিশিয়ে এটি তৈরি করা হয়
ইনট্রিনসিকে হোল এবং ইলেকট্রন সংখ্যা সমান p-type এ হোল সংখ্যা বেশি এবং n-type এ ইলেকট্রন সংখ্যা বেশি থাকে
ফারমি (Fermi) লেভেল ভ্যালেন্স ব্যান্ড এবং পরিবহন ব্যান্ড এর মাঝখানে থাকে ফারমি (Fermi) লেভেল p-type এর ক্ষেত্রে ভ্যালেন্স ব্যান্ড এর কাছাকাছি থাকে এবং n-type এর ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যান্ড এর কাছাকাছি থাকে।

p-type এবং n-type সেমিকন্ডাক্টরের মধ্যে পার্থক্য
p-type  
১. অপদ্রব্যের টাইপ ত্রি-যোজী ভেজাল বা অপদ্রব্য মিশিয়ে তৈরি করা হয় ।
২.ফারমি (Fermi) লেভেল ভ্যালেন্স বা যোজ্যতা ব্যান্ডের কাছাকাছি থাকে ।
৩. মেজোরিটি ক্যারিয়ার হচ্ছে হোল মেজোরিটি ক্যারিয়ার হচ্ছে ইলেকট্রন।

n-type
১. পঞ্চ-যোজী ভেজাল বা অপদ্রব্য মিশিয়ে তৈরি করা হয়
২. ফারমি (Fermi) লেভেল কন্ডাকশন বা পরিবহন ব্যান্ডের কাছাকাছি থাকে
৩. মাইনোরিটি ক্যারিয়ার মাইনোরিটি ক্যারিয়ার হচ্ছে ইলেকট্রন মাইনোরিটি ক্যারিয়ার হচ্ছে হোল।

Comments

Popular posts from this blog

বৈদ্যুতিক ফ্যান আস্তে চালালে বিদ্যুৎ খরচ কম আর জোরে চালালে কি বেশি খরচ হয়?

Custom Rom(কাষ্টম রম) কি? কিভাবে নিজেই এন্ড্রোয়েড এ কাস্টম রম ইন্সটল করবেন।।।

Best Custom ROM for Xiaomi Redmi Note 8